‘ধন্যবাদ’ ছোট্ট একটি শব্দ, যা আজ পর্যন্ত প্রথম আলোকে বলা হয়নি। প্রথম আলোর মঙ্গলবারের ক্রোড়পত্র ‘নকশার’ জন্য আজ আমি জেবুন্নেসা বেগম একজন রন্ধনবিদ। প্রথম কথাটি আমার সঙ্গে খুব যায়। আমার জীবনে প্রথম যে আলোর সন্ধান দিয়েছে, সে প্রথম আলো।
একটু ছেলেবেলায় ফিরে যাই। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি। পায়েস রান্না করি। সেটি আমার জীবনের প্রথম রান্না। মা খেয়ে বললেন অসাধারণ হয়েছে। আমি তো খুশিতে আটখানা। এবার বাবাকে পায়েস দিয়ে বললাম মা রেঁধেছেন। বাবা এক চামচ মুখে দিয়ে বললেন, ‘তোর মা কি রান্না ভুলে গেছে! তোর মায়ের এত বাজে রান্না আমি কখনো খাইনি।’ মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। বুঝে নিলাম রান্না সহজ বিষয় নয়। তাই মায়ের পাশে বসে রান্না দেখা আর চেখে দেখাই আমার মুখ্য বিষয়।
নিজেকে যাচাই করার জন্য প্রাণ–প্রথম আলো আচার প্রতিযোগিতায় অংশ নিলাম। তবে কীভাবে আচার বানাব? মা তো চট্টগ্রামের বাইরে! রেসিপিসহ আচার তৈরির কিছু টিপস ফোনে মায়ের কাছ থেকে জেনে নিলাম। পুরস্কার বিতরণীর মঞ্চে সুমনা শারমীন (ফিচার সম্পাদক) ঘোষণা করলেন, ‘প্রথম হয়েছে জেবুন্নেসা বেগম।’ ভাবলাম দেশের সাড়ে সাত হাজার প্রতিযোগী থেকে কারও নাম হয়তো বলছেন, সত্যিই কি আমি! অবাক হলাম, সত্যিই সেই দিনটি ভোলার নয়। ওই দিন নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে গেল।
পুরস্কার পাওয়ার বেশ কিছুদিন পর একদিন হঠাৎ নকশা থেকে ফোন এল। জানানো হলো নকশায় রান্নার রেসিপি দিতে হবে। সেই থেকে চট্টগ্রাম থেকে রান্নার রেসিপি পাঠাতে থাকলাম। আর সারা দেশের মানুষের কাছে সেগুলো পৌঁছে যেতে থাকল। আমি চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা। সেখান থেকে বিভিন্ন রান্নার প্রতিযোগিতা ও বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় রান্নার রেসিপি দিয়ে আসছিলাম। হঠাৎ করেই আমি ঢাকায় চলে আসি। সব প্রতিযোগিতা ও রেসিপি প্রকাশ থেকে সরে এলাম। বেশ কিছুদিনের জন্য রান্না থেকেও দূরে ছিলাম। সেই সময় নকশা আমাকে পরামর্শ দেয় রান্না না ছেড়ে দেওয়ার। নকশায় নিয়মিত প্রকাশিত রান্নার রেসিপি দেখার জন্য, আমি আবার নিজেকে নতুনভাবে তৈরি করি। তারপর আর আমাকে পেছনে তাকাতে হয়নি।
এ বছর নকশায় আমার প্রকাশিত বিভিন্ন রেসিপি ও আরও কিছু নতুন রেসিপি নিয়ে ফ্রন্টলাইন কমিউনিকেশন লিমিটেডের সহযোগিতায় একটি রান্নার বই প্রকাশ করতে সক্ষম হই। পাঠক জনপ্রিয়তার কারণে আমার ২০টি রান্নার রেসিপি নিয়ে প্রথম আলো অনলাইনে শুধু আমার রান্না দিয়ে ‘এস বস আহারে’ নামে একটি চ্যানেল খোলা হয়।
আজ আমি হয়তো একজন সাধারণ গৃহিণী হয়েই থাকতাম। নকশার কল্যাণে আজ আমি এত দূরে। উপস্থাপনাসহ রান্নার অনুষ্ঠান করে যাচ্ছি বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে। শুধু তা–ই নয়, জাতীয় রান্নার বিভিন্ন প্রতিযোগিতার বিচারক হিসেবেও কাজ করেছি। গত দুই বছর এসএ টিভিতে ৩০ জন রাঁধুনিকে নিয়ে রমজান মাসজুড়ে ইফতারি রান্নার অনুষ্ঠান করার সৌভাগ্য হয়েছে। আমার জন্য অনেক গর্বের যে দেশের বিভিন্ন জেলার স্কুলের শিক্ষার্থীদের রান্না শেখানোর অনুষ্ঠান শুরু করতে পেরেছি। ‘ব্ল্যাকবোর্ডের বাইরে’ অনুষ্ঠানটি দুই বছর ধরে প্রতি শুক্রবার চ্যানেল নাইনে প্রচারিত হচ্ছে।
রান্নার হাতেখড়ি মায়ের কাছে হলেও নিজেকে আরও ভালোভাবে তৈরি করতে সিটি অ্যান্ড গিল্ডস অব লন্ডন ইনস্টিটিউট (বিএফসিপস) থেকে ফুড প্রিপারেশন এবং কুকিং বিষয়ে লেবেল-১ এবং ফুড সেফটি অ্যান্ড ক্যাটারিং বিষয়ে লেবেল-২ কোর্স সম্পন্ন করি। এ ছাড়া এনএইচটিটিআই থেকে স্পেশাল কালিনারি ও বেকারি কোর্স এবং বাংলাদেশ স্মল ইন্ডাস্ট্রি থেকে সসের ওপর বিজনেস কোর্স সম্পন্ন করি।
‘এসিআই আনন্দ আলো জাতীয় ভর্তা প্রতিযোগিতা ২০১৭ ও ২০১৮’, ‘প্রাণ আচার প্রতিযোগিতা ২০১৮’ এবং ‘ওয়ার্য়পুল পিঠা উৎসব ও প্রতিযোগিতা ২০১৯’-এর বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। টিভি–পত্রিকার কাজ ছাড়াও আমি ফুড ক্যাটারিংয়ের কাজ করছি। ভবিষ্যতে বিভিন্ন শেফ ও রাঁধুনিদের নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখি।
হৃদয় থেকে ধন্যবাদ জানাই প্রথম আলো ও নকশা পরিবারকে। নকশা বেঁচে থাকুক প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে তাঁর সৃষ্টিশীল কাজের মাধ্যমে।
লেখক: রান্নাবিদ